ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ১৩/১২/২০২৩ ৯:১৮ এএম

নানা রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ কষে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ফের সম্পর্ক ‘পুনর্মূল্যায়ন’ করতে যাচ্ছে বিএনপি। দেশের ভেতরে ও বাইরে যে শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে জামায়াতের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ বজায় রেখেছিল, তা থেকে সরে আসার পরিকল্পনা কষছে দলটি। বিশেষ করে এর আগে জামায়াতের ব্যাপারে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আপত্তিকে ‘গুরুত্ব’ দিলেও আসন্ন নির্বাচনে দেশটির সমর্থন বিএনপির অনুকূলে নেই বলে মনে করছে তারা।

এ পরিস্থিতিতে রাজপথের চলমান আন্দোলনকে জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রধান বিরোধী দলটি। এ লক্ষ্যেই সব দল ও মতকে নিয়ে ‘একসঙ্গে’ মাঠে নামতে যাচ্ছে বিএনপি। গঠন করা হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী সর্বদলীয় ঐক্য’। এতে যেমন দীর্ঘদিনের পুরোনো মিত্র জামায়াতে ইসলামী থাকবে, তেমনি সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোকেও রাখা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ১৭ ডিসেম্বরের পরপরই এ পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারে। তবে জামায়াতকে নিয়ে যেসব সমমনা বাম দলের আপত্তি থাকবে, তাদের যুগপৎ আন্দোলনে শরিক রাখার কৌশলও রয়েছে দলটির। সরকার পতনের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে সব দল, মত এবং পথকে এক ও অভিন্ন করে এক মঞ্চে আনতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা সমকালকে জানান, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তারা দীর্ঘ এক বছর ধরে যুগপৎ আন্দোলন করছেন। শুরুতেই বলা হয়েছিল, আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে জোট গঠন কিংবা এক মঞ্চের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন সেই সময়টা এসেছে বলে তারা মনে করছেন।

দলটির নেতারা বলছেন, পরিস্থিতিই তাদের এক মঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অনেকে জামায়াতের বিষয়ে আপত্তি তুলতে পারেন। তবে আগে দেশ বাঁচাতে হবে। দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কে ডান, কে মধ্য আর কে বাম– তা দেখার সময় নেই। এখনই এক হতে না পারলে কেউ বাঁচতে পারবে না। ভোটাধিকার আর গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে যারাই আন্দোলন করছেন, তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াত এক মঞ্চে কর্মসূচি পালনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই কাজ শুরু করেছেন দুই দলের নেতারা। পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন থানা-ওয়ার্ডে টিমওয়ার্ক করছেন। তথ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে কর্মকৌশল ঠিক করতে উভয় অংশের নেতারা বৈঠক করছেন। জোট গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার পর রাজপথে এর কার্যক্রম শুরু হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, তারা এখন আন্দোলনের একটি কৌশলে আছেন। সেটা হচ্ছে, যুগপৎ। তবে আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে সবকিছু নির্ভর করবে পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। তখন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, বর্তমানে বিএনপি-জামায়াত মাঠে একই রকম কর্মসূচি দিচ্ছে। সেটা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমেই কর্মসূচি নির্ধারণ করছি। যেহেতু নির্বাচন এগিয়ে আসছে, স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলন আরও জোরদার হবে। সে ক্ষেত্রে আরও কত কাছাকাছি থেকে আন্দোলন করা যায়, সেই বিষয়টি চিন্তাভাবনা করছি।

শিগগিরই এক মঞ্চে উঠে বিএনপি-জামায়াত কর্মসূচি পালন করবে কিনা– এমন প্রশ্নের উত্তরে এই জামায়াত নেতা বলেন, সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সময়ের প্রয়োজনে যে কোনো কিছুই হতে পারে।
বিএনপি সূত্র জানায়, এক দফা আন্দোলনের শেষ ধাপে তারা সবাইকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। সেটা আগামী ১৭ ডিসেম্বরের পর দৃশ্যমান হবে। আর বাস্তবায়ন হতে পারে ২৬ ডিসেম্বরের পর থেকে। চূড়ান্ত আন্দোলনের আগ মুহূর্তে তারা একসঙ্গে মাঠে নামবেন, একসঙ্গে কর্মসূচি পালন করবেন। তবে সেখানেও রয়েছে বাধা। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির দু-একজন নেতা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছেন শুরু থেকে। তবে বেশির ভাগ রয়েছেন ইতিবাচক সিদ্ধান্তে।

বিরোধিতায় থাকা নেতাদের বক্তব্য– জামায়াতে ইসলামীকে এক মঞ্চে নিয়ে এলে আবারও ওই দলটির নেতিবাচক কার্যক্রমের দায়ভার বিএনপিকে বহন করতে হবে। বিএনপি ‘মৌলবাদী রাজনীতি’কে সমর্থন করে বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচারণা চালাবে সরকারি দলসহ বিরোধী পক্ষ। যুদ্ধাপরাধের বিষয়টিকে নতুন প্রজন্ম ভালোভাবে নেয়নি। এর বাইরে ‘ইসলামী ফোবিয়া’ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিষয়টি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হতে পারে।

তবে অন্য নেতাদের যুক্তি এর সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের মতে, দেশের তৃতীয় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের সাংগঠনিক ভিত্তি অনেক মজবুত। বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে রাজপথে কর্মসূচি পালন করলে খুব দ্রুত সময়ে ভালো ফল আসতে পারে। দেশে এখন একমাত্র জনইস্যু হচ্ছে– জনগণের ভোটাধিকার, স্বাধীন মতপ্রকাশ, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা। যে গণতন্ত্র ও মানবতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, দেশকে স্বাধীন করা হয়েছিল– তার কিছুই নেই এখন। সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে এখন সবাইকে ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ পক্ষের নেতারা বলেন, নাইন-ইলেভেনের টুইন টাওয়ার ভয়ংকর হামলার পর সারাবিশ্বে যে ‘ইসলামী ফোবিয়া’ সৃষ্টি হয়েছিল– তা এখন আর নেই। এতদিন ক্ষমতাসীন দল ওই ইস্যুকে পুঁজি করে অনেক জঙ্গি নাটক সৃষ্টি করেছে, যা এখন সবাই বুঝতে পারছে। তাই ওই ইস্যুকে আর কাজে লাগাতে পারবে না বিরোধী পক্ষ। অন্যদিকে জামায়াতকে নিয়ে সমস্যা থাকলে পশ্চিমা বিশ্ব এই দলটিকে এড়িয়ে চলত। সেটা হচ্ছে না। শুধু একটি পার্শ্ববর্তী দেশ এই ইস্যুকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে। তবে সেখান থেকে বিএনপির জন্য কোনো সুখবর নেই। তারা এই দেশে একটি দলের বাইরে যেতে পারছে না বলে তাদের প্রেসক্রিপশনে চলা যাবে না।

জানা গেছে, জামায়াত ছাড়াও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলোকেও এক মঞ্চে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করছেন দলের হাইকমান্ড। এরই মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চসহ ১২ দলীয় জোট, সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট, এলডিপি, গণফোরামসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। অনেকে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও বাম ঘরানার কেউ কেউ তুলেছেন আপত্তি। তবে শেষ পর্যন্ত তারাও দেশের স্বার্থে, আন্দোলনকে সফল করার স্বার্থে বৃহত্তর ঐক্যে আসবেন বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।

এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অনেকে কৌশলী বক্তব্য দিলেও অনেকে আছেন পুরোপুরি বিরোধিতায়। এর মধ্যে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে– সব বিরোধী দল একসঙ্গে মাঠে নামুক। এখন তারা যুগপৎ আন্দোলনে আছেন। সেখানে যার যার অবস্থানকে আরও জোরদার করে, বিস্তৃত করে মাঠে নামার চেষ্টা করছেন। এই আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠবে তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে কৌশল নির্ধারণ করা হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে কীভাবে মাঠে নামা যায়, কীভাবে আন্দোলন জোরদার করা যায়– সে বিষয়ে আলোচনা আছে। তবে তারা যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়েই শুরু থেকে কথা বলে আসছেন। সবাইকে এক মঞ্চে আনার বিষয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে কথা হচ্ছে, তবে সেটা চূড়ান্ত নয়।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সাধারণ সম্পাদক শহীদউদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, এক মঞ্চের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তবে আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্তে সেই সিদ্ধান্ত আসবে। আপাতত, যুগপৎ ধারায় তারা থাকতে চান। সে ক্ষেত্রে বিএনপির উদ্যোগকে নিরুৎসাহিতও করছি না।

গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, দেশের প্রয়োজনে এখনই সময় সবাইকে এক হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এখন আর কোনো বিরোধী মত থাকতে পারে না রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। তাতে দেশের সমূহ ক্ষতি হতে পারে।

১২ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ এলডিপি মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, সবাইকে এক মঞ্চে, এক কাতারে নিয়ে আসতে তারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। এখন ডান, বাম আর মধ্যম– সবাইকে এক হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দেরি হলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আশা করছি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে। সমকাল

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণের পক্ষে নয় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্র সচিব

রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণ বাংলাদেশের জন্য বিবেচনাযোগ্য বিকল্প নয় বলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ঢাকা প্রধান ল্যান্স ...

ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাসপাতালে ঢুকতে বিধিনিষেধ

ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাসপাতালে প্রবেশে বিধিনিষেধসহ ১০টি নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সরকারি ও বেসরকারি ...

আমাদের নিয়ত সহিহ, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হলেই নির্বাচন: সিইসি

অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন নতুন নির্বাচন কমিশনার ...